ঈশপের গল্প: প্রকৃত বন্ধু

ঈশপের গল্প সমগ্র থেকে প্রকৃত বন্ধু গল্পটি এবং প্রকৃত বন্ধু গল্পটির উপদেশ দেওয়া হল। যা পাঠ করলে তোমরা অনেক আনন্দ পাবে ও সেই সাথে গল্পটির উপদেশ জানতে পারবে।

প্রকৃত বন্ধু

একদা কোনো এক স্থানে এক হরিণের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল এক ধূর্ত শিয়ালের। সারাদিন একসঙ্গে ঘোরাফেরা করে সন্ধ্যা নাগাদ একটা চাপা গাছের তলায় গিয়ে ওরা উপস্থিত হলো। হরিণ তখন শেয়ালকে বলল এই চাঁপা গাছের তলায় আমি থাকি। ঐ চাপা গাছের ডালে একটা কাক থাকতো। তার সঙ্গে হরিণের গলায় গলায় ভাব ছিল। কাক-এর ভালো লাগল না বন্ধুকে শিয়ালের সঙ্গে আসতে দেখে।

একথা শুনে শেয়াল চটে উঠল – “আপনি আমার ওপরে অবিচার করছেন। হঠাৎ কারও সঙ্গে কারও বন্ধুত্ব হয় না। একের সঙ্গে অন্যের দেখাশুনা হয়, কথাবার্তা হয়, একে অন্যকে যোগ্য সহচর বলে বেছে নেয়। আমি ভালো কি মন্দ আপনি জানেন না। কয়েকদিন মেলামেশা করে আমার ব্যবহার দেখুন। আর বন্ধু হরিণের সঙ্গে আপনাদের প্রথম সাক্ষাতের দিন আপনিও তাঁর অপরিচিত ছিলেন। এখন ত আপনাদের দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক দিনের পর দিন বেশ অটুট হচ্ছে। এই হরিণ আপনার বন্ধু, আমারও বন্ধু। আজ থেকে আপনিও আমার বন্ধু। আসুন, আমরা তিন বন্ধুতে মিলেমিশে সুখে থাকি। কাক মুখ গোমড়া করে থাকলো।

এরপর বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। শিয়াল হরিণকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরে। কাক কোনোদিন সঙ্গে যায়, কোনোদিন যায় না। তবে তার মনে দুশ্চিন্তা রয়েই গেল। একদিন শেয়াল হরিণকে গোপনে বলল – “বন্ধু, এই বনের একপ্রান্তে একটি ফসলের ক্ষেত আছে। আমি তোমাকে সেটা দেখিয়ে দেবো। তুমি সেখানে বেশ কয়েকদিন সুখে চরতে পারবে। খাওয়ার কোনো অভাব হবে না।”

শেয়াল হরিণকে ক্ষেতটা দেখিয়ে দিলে হরিণ রোজ সেখান যায় আর পেট ভরে খেয়ে আসে। কয়েকদিনেই হরিণের চেহারা পাল্টে গেল। শিয়াল দেখে আর ভাবে, কবে এই হরিণের মাংস খেয়ে সে তৃপ্তি পাবে। এদিকে ক্ষেতের মালিকের নজরে পড়ল, কে যেন তার ক্ষেতের ফসল খেয়ে যাচ্ছে। একদিন সে চুপি চুপি ক্ষেতের মধ্যে ফাঁদ পেতে রাখল।

পরের দিন হরিণ মনের আনন্দে ক্ষেতে চরতে এসে সেই ফাঁদে ধরা পড়ল। যতই সে পা ছোঁড়ে ততই ফাঁদটা শক্ত হয়ে পায়ে আটকে যায়। সে ভাবতে লাগল বন্ধু শিয়াল ছাড়া আর কেই-ই বা তাকে এই শক্ত ফাঁদ কেটে বাঁচতে পারবে। শিয়াল আশেপাশে ঘুরঘুর করছিল। হরিণকে ফাঁদে পড়তে দেখে তার মনে কি উল্লাস। সে কতদিন ধরে ভেবে ভেবে হরিণকে কায়দার মধ্যে ফেলেছে। এইবার তার পোয়া বারো।

হরিণ ফ্যাল ফ্যাল করে চারদিকে তাকাচ্ছিল। হঠাৎ দূরে শিয়ালকে দেখতে পেয়ে ডাকল, “এই তো বন্ধু তাড়াতাড়ি তোমার ধারালো দাঁতে ফাঁদ কেটে আমাকে বাঁচাও। ক দিন থেকে কাক আমাদের সঙ্গে মন খুলে মেলামেশা করছে না তার মনের সন্দেহ এখনো কাটে নি। তুমি ফাঁদ কেটে আমাকে উদ্ধার করে কাকের মনের সন্দেহ দূর করো। সে বুঝতে পারবে অসময়ের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু।”

শিয়াল কাছে এসে ফাঁদটা ভালো করে পরীক্ষা করে দেখে বলল – “বন্ধু, এই ফাঁদ দড়ির নয়, জন্তুর স্নায়ু দিয়ে তৈরি। জানো তো আমি বৃহস্পতিবারে মাছ-মাংস খাওয়া একদম ছেড়ে দিয়েছি। আজ বৃহস্পতিবার আমিও ফাঁদ দাঁতে কাটতে পারবো না আজ। বন্ধু, কিছু মনে করো না, ভালোয় ভালোয় রাতটা কাটুক কাল সকালে আমি তোমাকে নিশ্চয়ই ফাঁদ থেকে উদ্ধার করবো।

এদিকে কাক সন্ধ্যের সময় বাসায় ফিরে দেখে হরিণ সেখানে নেই। তার ছ্যাঁৎ করে উঠলো। সকাল থেকেই তার মনটা আজ খুব খারাপ। বন্ধু হরিণের কোনো বিপদ ঘটলো না তো। তখন কাক আকাশে উড়ে বনের চারিদিকে তন্ন তন্ন করে দেখতে লাগলো। হঠাৎ তার নজরে পড়ল দুরে একটা ফসলের ক্ষেতের দিকে। ক্ষেতের কাছে গিয়ে কাক দেখে হরিণ ফাঁদে পড়েছে।

কাক জিজ্ঞেস করল – “বন্ধু, ব্যাপার কি?

হরিণ তখন শিয়ালের কুটবুদ্ধির পাল্লায় পড়ে কি দুর্গতির মধ্যে পড়েছে সেই কাহিনী আগাগোড়া বলে কাকের কাছে মাপ চাইল। বলল – “ তোমার মতো বন্ধুর, পরামর্শ না শুনে অপরিচিতের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে গেছিলাম সেই পাপেরই এই ফল।”

কাক বললো – “তুমি কিছুমাত্র চিন্তা করো না। মন শক্ত করো। আমি তোমাকে যেভাবেই হোক বাঁচাব।” হরিণের দুর্গতি দেখে কাকের কান্না পাচ্ছিল, সে চোখ মুছে জিজ্ঞেস করল – “সেই দুষ্টু শিয়াল কোথায় ?”

হরিণ ফুঁপিয়ে কেঁদে বলল – “আমার মাংস খাবার লোভে আশেপাশেই হয়তো ঘুরঘুর করছে।” কাক সে রাতে হরিণকে ছেড়ে চাপা গাছের বাসায় আর গেল না। হরিণের কাছে থেকে তাকে সাহস দিতে লাগল, আর লক্ষ্য রাখতে লাগল যাতে শিয়াল এসে হরিণের কোনো অনিষ্ট করতে না পারে।

হরিণ আর কাক সারারাত দুশ্চিন্তায় কাটাল। কেউ আতঙ্কে দু’চোখের পাতা এক করতে পারল না। দূর থেকে ধূর্তশিয়াল কাককে দেখে রাগে গরগর করতে লাগল। তার হাতের মুঠোয় মধ্যে পেয়েও সে হরিণের মাংস খেতে পেল না।

এদিকে ভোর হয়ে এল। কাক অভ্যাসমতো দু’একবার কা কা করে চুপ করে গেল। হঠাৎ সে দেখল দূরে ক্ষেতের মালিক মোটা লাঠি নিয়ে ক্ষেতের দিকে আসছে। সে সঙ্গে সঙ্গে হরিণের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল – “বন্ধু, ক্ষেতের মালিক এইদিকেই আসছে। তুমি পেটটা যতখানি সম্ভব ফুলিয়ে তোল, পা’গুলো একেবারে অসাড় করে রাখো আমি তোমার মাথায় বসে চোখের কোণটা ঠোকরাবার ভাণ করছি। খুব ভালো অভিনয় করা চাই। একেবারে মড়ার মতো পড়ে থাকো। তবে আমি যখনই কা কা করে ডেকে উঠবো, তুমি সঙ্গে সঙ্গে ছুটবে। তোমার পা চারখানি তো বাতাসের চেয়ে বেগে ছুটতে পারে।

কাকের কথামতো হরিণ পেট ফুলিয়ে দম বন্ধ করে পাগুলো অসাড় করে রইল। কাক তার চোখের কাছে ঠোঁট রেখে দেখাতে লাগল, সে যেন একটা জন্তুকে ঠোকরাচ্ছে। ক্ষেতের মালিক দূর থেকেই হরিণকে ফাঁদে আটকা পড়েছে দেখতে পেয়ে উল্লসিত হলো। এরপর ক্ষেতের মালিক খুব কাছাকাছি আসতেই কাক একটু দূরে উড়ে বসল। ক্ষেতের মালিক লাঠি উঁচিয়ে হরিণটাকে এক ঘা বসাবে ভেবেছিল। কাকটাকে দেখে তার একটু সন্দেহ হচ্ছিল। এখন কাছে এসে দেখল, হরিণটার পেটটা ঢোলের মতো ফুলে উঠেছে, পা গুলো সব অসাড়, চোখ দু’টো কোটর ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। দেখে সে আপন মনে বলল – ‘আপদটা নিজে নিজেই মরেছে দেখছি। পাপের শাস্তি আছেই। এভাবে পরের ফসল নষ্ট করলে সে তো পেট ফুলে মরবেই।”

এইসব বলতে বলতে ক্ষেতের মালিক হরিণের পা থেকে ফাঁদটা খুলে নিয়ে একটু দূরে গিয়ে ফাঁদ গোটাতে লাগল। দূর থেকে কাক এতক্ষণ সব লক্ষ্য করছিল। এইবার সুযোগ বুঝে কাক কা কা করে ডেকে উঠল। অমনি হরিণ তড়াক করে লাফিয়ে উঠে মারল এক দৌড়।

“আরে আরে হরিণটা তো মহা শয়তান! পেটটা ওর ফসল খেয়ে ফোলেনি, ওটা কু-বুদ্ধিতে ফুলিয়ে রেখেছিল” বলতে বলতে ক্ষেতের মালিক তাক করে ছুঁড়ল তার হাতের মোটা লাঠিটা। হরিণ কিন্তু তখন নাগালের বাইরে অনেক দূরে চলে গেছে। ব্যাপারটা দেখবার জন্য শিয়াল তখন একটু এগিয়ে এসেছিল। আর পড়বি তো পড় – লাঠিটা গিয়ে পড়ল তারই মাথায়। দূরে একটা জন্তুর কাতর চিৎকার শুনে ক্ষেতের মালিক সেদিকে ছুটল। গিয়ে দেখল একটা শিয়াল লাঠির ঘায়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। মালিক তখন রাগের চোটে তার গায়ে মাথায় দমাদম লাঠির ঘা দিতে লাগল।

প্রকৃত বন্ধু গল্পটির উপদেশ

প্রকৃত বন্ধু গল্পটির উপদেশটি হল – “বন্ধুকে বিপদের সময় বুদ্ধি করে বাঁচাতে হয়।”

একসাথে ঈশপের গল্পগুলির উপদেশ বা নীতি কথাগুলি পড়ুন-

ঈশপের গল্প সমগ্র

বলবান ও দুর্বল
সেয়ানে সেয়ানে
যেমন কর্ম তেমন ফল
অতি চালাকের গলায় দড়ি
এক শেয়াল ডালুকের গল্প
তিনটি ষাঁড় আর সিংহ
সিংহ ভেড়া আর নেকড়ে
এক যে ছিল কুকুর
সাপ ও বোলতা
১০মোরগ ও বেড়াল
১১গাধার গর্ব
১২বেঘোরে প্রাণ
১৩হাঁস যখন গান গায়
১৪খরগোশ আর কচ্ছপের গল্প
১৫সাপ ও কৃষক
১৬কাক আর রাজহাঁস
১৭খেলা
১৮শেয়াল ও সিংহ
১৯বড়াই
২০কাঁটার ঝোপে শেয়াল
২১এক ব্যাধ ও পোষা পায়রা
২২স্বার্থপর ঘোড়া
২৩মোরগ ও চোর
২৪নেকড়ে বাঘ ও ভেড়ার বাচ্চা
২৫কাপুরুষ
২৬শুশুক ও বানর
২৭হাতের পাঁচ
২৮ডুমুর ও দাঁড়কাক
২৯ফোঁস করতে হয়
৩০গাধা, চাষী ও তার ছেলে
৩১পিতা এবং চার পুত্র
৩২শিয়াল এবং ছাগল
৩৩একচক্ষু হরিণ
৩৪এক ব্যাঙ ও এক সিংহ
৩৫সূর্য ও পবন
৩৬এক চাষী ও তার ছেলেরা
৩৭লোভের পরিণাম
৩৮ছাগল ও বাঘের গল্প
৩৯এক ছিল নেকড়ের ছানা ও এক যে ছিল রাখাল
৪০শিয়ালের শিক্ষা
৪১সারস ও কৃষক
৪২কুকুর এবং তার ছায়া (প্রতিবিম্ব)
৪৩কপোত ও কাক
৪৪এক বাঁদরের গল্প
৪৫চালাকির সাজা
৪৬বুদ্ধিই বল
৪৭একটি ইঁদুর ও সাপ এবং নেউলের গল্প
৪৮একটা ইঁদুর আর ব্যাঙের গল্প
৪৯এক সিংহ ও এক চাষী
৫০বিশ্বাসঘাতক নেকড়ে
৫১শিয়ালের চালাকি
৫২সোনালী মাছ
৫৩বার্ধক্যগ্রস্ত সিংহ
৫৪লম্বা লম্বা কথা বলা
৫৫ভাই বোন
৫৬সারস ও বাঘের গল্প
৫৭এক পাখি আর ব্যাধ
৫৮নেপোয় মারে দই
৫৯প্রতিফল
৬০একমনে কাজ করতে হয়
৬১ভাগ
৬২সিংহ ভাগ
৬৩ঘোড়ার ছায়া
৬৪ইঁদুরের পরামর্শ
৬৫মধুর কলস ও মাছি
৬৬একটি দাঁড়কাক ও অন্য কাকেরা
৬৭কাঠুরে ও জলদেবতা
৬৮একটি মুক্তো ও মুরগী
৬৯জাবনার পাত্রে কুকুর
৭০আগে আমাকে তোল
৭১রাজহাঁস এবং সোনার ডিম

Leave a Comment